শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

বাল্য বিবাহ রোধে প্রয়োজন যৌথ উদ্দোগ



সুং হিয়ং লি

কান্ট্রি ডিরেক্টর, গুডনেইবারস বাংলাদেশ

 







ঘটনাঃ ০১
ঘটনাটি ১৯৭৮ সালের সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ উপজেলার চালা-শাহবাজপুর গ্রামের মজনু ভূঁইয়ার ছোট মেয়ে মেরিনা বয়স কতই বা হবে আর - কি বছর একদিন সে ফ্রক পড়ে বাড়ীর আঙ্গিনায় খেলছিল একসময় তার মা এসে তাকে সাজিয়ে-গুঁজিয়ে কিছু লোকের সামনে নিয়ে গেল জানা গেল সেদিন তারা মেরিনাকে দেখতে এসেছিল সেদিন মেরিনা বুঝতেও পারলো না যে তার জীবনে কি ধরনের বিপর্যয় নেমে আসছিল এর কিছুদিন পর মেরিনার বিয়ে হয়ে গেল বছর খানেক পরে খবর পাওয়া গেল যে মেরিনা আর নেইমাহতে গিয়ে মেরিনা ইহজগতের মায়া ত্যাগ করে পরজগতের পথ পাড়ি দিয়েছে
মেরিনারা তো এভাবেই অকালে ঝরে যাবে - পৃথিবী থেকে তো তাদের এভাবেই চলে যাওয়া উচি! পুতুলের ঘর-সংসার খেলা শেষ হতে না হতেই, স্বামী-শ্বশুর বাড়ী-সংসার সম্পর্কে কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই যদি তাদের বিয়ে হয়ে যায়, তবে তো তাদের ভাগ্যে এই- ঘটবে

ঘটনাঃ ০২
আক্তার বানু জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার জিন্দারপুর ইউনিয়নের বাখরা গ্রামের আকিমুদ্দিনের একমাত্র মেয়ে ১৩ বছরের কিশোরী আক্তার বানু ছিল গুডনেইবারস্ বাংলাদেশের (জিএনবি) কালাই সিডিপির অন্তর্গত মোলামগাড়ীহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীর একজন মেধাবী ছাত্রী গত আগষ্ট ২০১৩ মাসে আক্তার বানুর পরিবার অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে তার বিয়ে দেয় আক্তার বানু, জিএনবি বা সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের শত চেষ্টার পরেও আকিমুদ্দিন তার মেয়েকে নিশ্চিত বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে

প্রথম ঘটনাটি ছিল আজ থেকে প্রায় ৩৫ বছর আগের আর দ্বিতীয় ঘটনাটি আজ থেকে ৩০ দিন আগের বিগত ৩৫ বছরে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে; উন্নয়ন ঘটেছে মানুষের জীবনযাত্রার মানেরও কিন্তু মেরিনা, আক্তার বানুদের গল্পের কি উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন ঘটেছে?

ইউনিসেফ, ২০০৯  এর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, গত দশকে বাংলাদেশে বাল্য বিবাহ প্রথা কমে গিয়েছে আমরাও জানি যে, দেশে বাল্য বিবাহের পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে কিন্তু এই উন্নতি কি সন্তোষজনক? অথবা এই উন্নতির মাত্রা কোথায় বেশী? একটি জরিপে দেখা গেছে যে , বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ৭৫% মেয়েদের ১৬ বছরের পূর্বেই বিয়ে হয়ে থাকে ইউনিসেফ, ২০০৯১ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাল্য বিবাহের প্রচলন গ্রামাঞ্চল শহরাঞ্চলের বস্তি এলাকায় বেশী গ্রাম, শহর বস্তি এলাকা অনুযায়ী বাল্য বিবাহের প্রাদুর্ভাবের কারণ হিসাবে জিএনবি মাঠ পর্যায়ে তার অভিজ্ঞতার আলোকে যে বিষয়গুলো চিহ্নিত করেছে সেগুলো হচ্ছেঃ দরিদ্র্যতা, বাল্য বিবাহের কুফল সম্পর্কে অজ্ঞতা, নিরক্ষরতা, কু-সংস্কার, ধর্মান্ধতা, সামাজিক প্রথা, বাল্য বিবাহ আইন বাস্তবায়নের অভাব, প্রেম ঘটিত বিষয় ইত্যাদি

বাল্য বিবাহের ফলে একজন কিশোরী ব্যক্তিগত, পারিবারিক সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এর ফলে কিশোরীর শারীরিক মানসিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে অকাল গর্ভধারণের ফলে তাকে মারাত্ম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকতে হচ্ছে যা কখনো কখনো তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে পাশাপাশি, কিশোরী মায়ের গর্ভজাত শিশু নানাবিধ শারিরিক সমস্যা নিয়ে ভূমিষ্ট হচ্ছে, যা শিশুটির ভবিষ্যতের বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করছে

আবার অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার ফলে কিশোরীর স্বামী-সংসার সম্পর্কে কোন রকম ধারণা পাওয়ার আগেই শ্বশুর বাড়ী এসে সংসারের হাল ধরতে হচ্ছে

কিশোরীর শ্বশুর বাড়ী থেকে দাবীকৃত যৌতুক প্রদানের ব্যর্থতার কারণে কিশোরী বধূকে শারীরিক মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়ে থাকে ফলশ্রুতিতে কখনো কখনো কিশোরী বধূকে আতœহত্যার পথ বেছে নিতে হচ্ছে

বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ আইন ১৯২৯ এর ধারা বর্ণিত যে শাস্তির বিধান রয়েছে তা দেশের বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে যথেষ্ট নয় আবার, দেশের বাল্য বিবাহ সমস্যা সমাধানে সরকার, বেসরকারী সংস্থা বা সুশীল সমাজের একার উদ্যোগও যথেষ্ট নয় এর জন্য প্রয়োজন সরকার, বেসরকারী সংস্থা সুশীল সমাজের যৌথ উদ্যোগ তবে এই ত্রিপাক্ষিক উদ্যোগকে সফল করার জন্য পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য
সরকারের ভূমিকাঃ
.             Public Private Partnership উদ্যোগের মাধ্যমে কাজ করা;
.             বেসকারী সংস্থাকে কাজ করার সুযোগ দান;
.            বাল্য বিবাহ আইন সংশোধন করে সময়োপযোগী করে তোলা;
.             আইনের যথোপযুক্ত বাস্তবায়ন;
.             বিনামূল্যে ভূক্তভোগীদের আইনী সহায়তা প্রদান

বেসরকারী সংস্থাসমূহের ভূমিকাঃ
.             মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের দ্বারা স্থানীয় পর্যায়ে নেটওয়ার্ক তৈরী করা;
.             মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মাধ্যমে গণসচেতনতা সৃষ্টির কার্যক্রম হাতে নেয়া;
.            কর্ম এলাকায়বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ কমিটিগঠন সক্রিয় করে তোলা;
.             সরকার সুশীল সমাজের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা;
.             ভূক্তভোগীদের আইনী সহায়তা গ্রহণে উদ্যোগী করে তোলা সহযোগিতা করা

সুশীল সমাজের ভূমিকাঃ
.             সরকার বেসরকারী সংস্থাসমূহের সাথে সমন্বয় সাধন করে কাজ করা;
.             বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ কমিটি’-তে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা;
.            বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে গণসচেতনতা সৃষ্টিতে সহায়তা করা

মেরিনা আক্তার বানুর ঘটনার মধ্যকার সময়ের ব্যবধান ৩৫ বছরের পাশাপাশি ঘটনাদ্বয়ের মধ্যেও কিছুটা পার্থক্য রয়েছে মেরিনার বিয়ের সাথে সম্পৃক্ত ছিল তার পরিবার, সমাজ সকলেই কিন্তু আক্তার বানুর বিয়ে হয়েছিল কেবলমাত্র তার পরিবারের ইচ্ছায়, অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে এই দুই ঘটনার বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, বর্তমানে সমাজের জনগণ বাল্য বিবাহ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন হয়েছে বাল্য বিবাহ রোধে সরকারও যথেষ্ট সোচ্চার আর এটি সম্ভব হয়েছে সরকারেরশিশু বিকাশ কেন্দ্র তৃণমূল পর্যায়ে কর্মরত বেসরকারী সংস্থাসমূহের উদ্যোগের কারনে তবে এই উদ্যোগকে আরো কার্যকরী করতে প্রয়োজন সরকার, বেসরকারী সংস্থা সুশীল সমাজের মধ্যে সমন্বয় আর এই যৌথ উদ্যোগই পারবে সমাজের আপামর জনসাধারনকে বাল্য বিবাহ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে, পারবে সোচ্চার করতে আমাদের বিশ্বাস, সেদিন আর খুব দূরে নেই, যেদিন বাল্য বিবাহের ভয়াল থাবা থেকে আমরা মেরিনা বা আক্তার বানুদের রক্ষা করতে পারবো, পারবো তাদের একটি সুন্দর ভবিষ্য উপহার দিতে